বাড়ি ফেরার দিন টি আমাদের সবার কাছে একটু বেশি খুশির ও আবেগের। বাড়ি যাবো বলেমনে মনে কতো কতো পরিকল্পনা সাজানো থাকে। সেদিন ভোর ছ’য়টায় আমি বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। উদ্দেশ্য বাড়ি যাওয়ার হলেও ভাবনা কিন্তু ছিলো আমার মধুপুর কারিতাস ও মিশন। ব্যাগের এক কোনায় খুব যত্নে নিয়েছিলাম হাফসিল্ক একটা শাড়ি, শাড়ি পড়ে পাহাড়ি কণ্যা হয়ে যাবো বলে। টাংগাইলের ভাষায় “গরম ভাতে পানি” দিয়ে প্রচুর বৃষ্টি থাকায় আর শাড়ি পড়ার সাহস টা হয়নি সেদিন।
ভাওয়ালের পথ ধরে গা জমে বরফ হওয়ার মতো বাতাসকে উপেক্ষা করে সেদিন পৌঁছে ছিলাম আমার স্বপ্নের কারিতাসে।বেশ কিছুদিন আগেই শুনতে পাই করুন অবস্থা কারিতাসের। নিজ জেলা, নিজ উপজেলার কারিতাস একবার চোখে না দেখলেই না। কারিতাস মূলত একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ১৯৬৭ সালে সমাজকল্যাণ উন্নয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই প্রতিষ্ঠানটি খ্রিস্টান ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থা (কোর) নামে পুনর্গঠিত হয়। কোর ১৯৭১ সালের ১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংস্থার রূপ লাভ করে এবং ১৯৭২ সালের ১৩ জুলাই দি সোসাইটিস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬০ অনুযায়ী নিবন্ধন গ্রহণ করে। ১৯৭৬ সালে এটি ‘কারিতাস বাংলাদেশ’ নাম ধারণ করে।
কারিতাসের পূর্বের অবস্থা কি ছিলো —
কারিতাস এলাকায় আমরা যখন পৌঁছাই তখন দুপুর ২ টা। সবাই লান্স ব্রেক নিচ্ছেন তখন। আমরা এই ফাঁকে শুনে নেই ওই এলাকার একজনের আবেগ ও স্মৃতিজড়ানো কিছু কথা।
বছর ২৫ আগে, তার বিয়ের জন্য কারিতাস সিল্কের শাড়ি ও পাঞ্জাবি নেন তিনি শুধুমাত্র দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে ও নিজ উপজেলার পণ্যের প্রতি ভালোবাসা রেখে। তার ভাষ্য মতে তখনই ওই শাড়ির দাম ছিলো ২৫০০ টাকা ও পাঞ্জাবি ছিলো ১৫০০ টাকা। এতো বছরের শাড়িটা স্বযত্নে রেখে দিছেন তার বউ। বিয়ের সেই শাড়ি হাত দিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদেরও।
কারিতাস আগের মতো এখন আর নেই, তবুও ঈদের সময় হলে দেখা যায় সেনাবাহিনীর গাড়িতে পুরো রাস্তা ব্লক। এখানে সবাই আসে তাদের প্রিয়জনের জন্য সিল্কের শাড়ি নিতে। এই যে বছরের পর বছর কারিতাস সিল্কের প্রতি তাঁদের আবেগ জড়িয়ে আছে তা হয়তো ধীরে ধীরে বিলীন হতে যাচ্ছে।
কেননা কারিতাস আগে বাহির থেকে যা অনুদান পেতো এখন তা তেমন ভাবে পাচ্ছে না। সিল্কের তাঁত গুলো প্রায় বন্ধ সবই, সুতার তৈরির প্রকল্প তাঁদের বন্ধ ।এর মানে দাঁড়ায় তারা সঠিকভাবে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
কারিতাসের বর্তমান কাজের অবস্থা
লান্স আওয়ার শেষে আমরা কারিতাসে যাই এবং কথা বলি প্রথমে কারিতাসের ম্যানেজারের সাথে। নারী কর্মীরা তখন ছোট ছোট কাজ করছিলেন। আমরা তাঁতে ঢুকতেই দেখতে পাই ইয়ারফোন ব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ব্যাগের লগো হিসেবে লিখা “কারিতাস জার্মানি” লিখা টা দেখে আমার বেশ অবাক লাগে, দেশীয় পণ্যের সাপোর্টার হিসেবে আমার খুব কষ্টও লাগে। এমনটা কেনো করা হয় তা কর্মীরাও জানেন না।
আমি বেশ আগ্রহ দেখাই পাটের তৈরি এই ব্যাগ গুলো নিয়ে। কিন্তু ম্যানেজার সাহেবা বারবারই আমাকে বলছিলেন “দিদি এই ব্যাগ গুলো জার্মান ও ফ্রান্সের জন্য তৈরি করছি আমরা, এগুলো ওই দেশের পণ্য” বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আমি এই বিষয়ে তাঁকে করলে তিনি জানান-
কারিতাস এখন বিদেশের অর্ডার নিয়ে কাজ করতে ব্যস্ত। পাল্টা প্রশ্নে আমি অর্ডার দিতে চাইলেই বেরিয়ে আসে তাঁদের আসল কথা ও উওর। তারা জানান, আমাদের দেশের তৈরি এই পণ্য গুলো তারা কখনোই দেশের জন্য তৈরি করে না, হিউজ অর্ডার দিলেও না। মোড়াল অব দ্যা স্টোরি- বাংলাদেশী পণ্য হলেও পরিচিত পাবে বিদেশি পণ্য হিসেবে।
কারিতাস সিল্ক
সিল্ক নিয়ে আমরা সেনাবাহিনী ও এলাকার একজনের আবেগের কথা শুনেছি। কিন্তু সিল্ক পল্লী দেখতে গিয়ে আমরা দেখি তাঁত গুলো পুরোপুরি বন্ধ। কারিতাসের একজন নারীকর্মী জানান – সবাই ছুটিতে ছিলো তাই তাঁত বন্ধ। এছাড়াও বড়দিনের পর কাজ শুরু করা হয়নি এখন আর। আমরা দেখলাম একপাশে সুতা বোনা হচ্ছে কাজ শুরু করার জন্য। কারিতাসেরই একজন ছেলে কর্মী আমাদের ঘুরিয়ে দেখায় কালিতাসের পুরোটা।
কারিতাসের বাটিক
বাটিকের এই তথ্যটা পুরোপুরি আমাদের অজানা ছিলো। মিলে ঢুকে আমরা একদমই অবাক হয়ে যাই, বাটিক কাপড়ের বেশ কিছু টুকরো পাই যা দেখে আমি একজন ক্রেতা হিসেবে মুগ্ধ হয়ে গেছি। কারিতাস সংস্থা নিজেরাই বাটিকের পুরো কাজটা করছে।
সবশেষে আমরা স্টোরে গিয়ে দেখতে পাই বাহারি ড্রেসের সমাহার। যেখানে সবথেকে বেশি মুগ্ধ করে আমাকে সিল্ক শাড়ি ও বাটিক শার্ট গুলো। তাদের সাথে কথা বলি আমি আমাদের কারিতাস সিল্কের খোঁজ নিয়ে।
আমি ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপের সাথে যুক্ত আছি প্রায় দেড় বছর ধরে। এই গ্রুপ ই -কমার্স খাতের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রাজিব আহমেদ স্যারের এই সফল গ্রুপ, যাকে আমরা অনলাইনের ই- কমার্স শিক্ষা ভিত্তিক বিষে পয়সার সেরা বিদ্যাপিঠ হিসেবে মনে করি। ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যারের একটা আইডিয়ার নাম “আরিফা মডেল”। এই মডেলের মাধ্যমে আমরা জেনেছি দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ও প্রত্বন্ত গ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে। আরিফা মডেলের বেশ কয়েকটি টাস্ক এর মাঝেই একটা টাস্ক ছিলো জেলা পণ্য।
আমাদের কারিতাস সম্পর্কে জানাশোনার শুরুটা এখান থেকেই। আরিফ মডেলের মাধ্যমে মধুপুরের তাঁতশিল্প সম্পর্কে যতোটা জানতে পারছি ধীরে ধীরে সেই জানাশোনা থেকেই আমরা মনে হয় আমাদের আগে শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত দেশীয় পণ্যের প্রতি। দেশের পণ্য দেশেই স্থান পেলে আমাদের আর শুনতে হবে না দেশের এই তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দেশের ওই তাতী হতাশ হচ্ছেন। ইভেন আমাদের কারিতাসের কথাই যদি বলি –
করিতাস যদি দেশের পণ্য দেশেই রাখার চিন্তা করে এবং উদ্যোক্তারা যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে সেভাবে যদি সাপোর্ট করে যায় তাহলে খুব শীঘ্রই কারিতাস আগের পর্যায়ে ফিরে আসবে।
আমিনা, স্বত্বাধিকারী – আচিক অরণ্য