ইলেকট্রনিক কমার্সকে সংক্ষেপে ই-কমার্স বলা হয়। আধুনিক ডেটা প্রসেসিং এবং কম্পিউটার ভিত্তিক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পণ্য বা সেবা মার্কেটিং, ক্রয়-বিক্রয়, গ্রহণ-বিলি করা, ব্যবসা সংক্রান্ত লেনদেন ইত্যাদি করাই হচ্ছে ই-কমার্স। আর দিনাজপুরের তাঁত শিল্পকে যদি এই ই-কমার্সের আওতায় আনা যায় তাহলে দিনাজপুরের তাঁত শিল্পের জন্য এটি হবে একটি বিশাল সম্ভাবনা। তখন শুধু জেলার চাহিদা নয়, পুরো দেশসহ বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব দিনাজপুর জেলা তাঁত পন্য।
তাঁত কি?
মূলত তাঁত হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র যে যন্ত্র দিয়ে তুলা উৎপন্ন হয় আবার সে তুলা হতে উৎপন্ন হয় সুতো। সেই সুতো বুননের মাধ্যমে কাপড় বানানো যায়।
তাঁত বিভন্ন রকমের হতে পারে। খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তন্তু শব্দটির অর্থ তাঁত আর বয়ন শব্দটির অর্থ বোনা। “তন্তু বয়ন” কথাটি থেকে এসেছে
“তাঁত বোনা” শব্দ কটি। তাঁত বোনা যার পেশা সে হল তন্তুবায় বা তাঁতী। আর এই তাঁতের উপর যারা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।
তাঁতশিল্পের ইতিকথাঃ
এই তাঁত শিল্পের সঠিক ইতিহাস বলা মুশকিল। তবে পূর্বের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক।
তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায় যে তাঁত শিল্প মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে এই বস্ত্র তৈরি করে আসছে। মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল প্রধানত তিন প্রকার ছিলো। যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে তৈরি সামগ্রী বাঙালি সমাজ খুব আনন্দের সাথে গ্রহন করে এবং ব্যবহৃত করে।
বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। হস্ত চালিত তাঁতে বছরে প্রায় ৭০ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয় যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ মিটিয়ে থাকে। দেশের মোট কাপড়ের চাহিদার শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ যোগান দিচ্ছে তাঁত শিল্প এবং প্রায় ৫০ লাখ লোক সরাসরি এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে ।
আমাদের দেশে পোশাক ছাড়া সভ্যতাকে কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না। তাই বলা যায় এই শব্দ দুটি একই সূত্রে গাঁথা।
আর পোশাক নিয়েই কাজ করে চলেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার তাঁতিরা। কিন্ত বাস্তবতা হলো নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকার পরেও আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়েই দেশের বিভিন্ন জেলার তাঁতশিল্পের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তাঁতের নানা ধরনের কাপড় তৈরি করে চলেছেন। ঠিক এমনি ভাবেই দিনাজপুরের তাঁতিরাও বংশের জের ধরে কোনো রকমে টিকে আছে তাঁতশিল্প নিয়ে।
দিনাজপুরের তাঁত শিল্পঃ
দিনাজপুরের তাঁতিরা তাঁতশিল্প ধরে রেখেছেন তাদের বাপ-দাদার বংশ পরম্পরার তাঁতশিল্পকে। এটাকে আসলে বলা যায় জীবিকা নয় ভালোবাসা আর আবেগের টান থেকে তাঁতশিল্পকে ধরে রাখা।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলার প্রায় ১৩ টি গ্রামে ব্রিটিশ আমলে গড়ে উঠেছিলো বৃহত্তর রানীবন্দর তাঁতশিল্প অঞ্চল বা তাঁতপল্লী। সেই থেকে তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে রানীবন্দরের পরিচিতি ছিলো দেশ জুড়ে। এখানকার সুদক্ষ তাঁতশিল্পদের হাতে উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালা, মশারী ও গুলটেক্স চাদরের চাহিদা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। পর্যবেক্ষনে জানা গেছে যে দিনাজপুরের তাঁতের কাপড় যথেষ্ট পরিবেশ বান্ধব। এই কাপড় পরিধানে কোন রকম এলার্জি হয় না। এছাড়া কাপড়ের রঙ ও সুতা বেশ পাকা।
খুব বেশিদিন হয় নি ১০ বছর আগেও দিনাজপুরের তাঁত পল্লীগুলোতে হাজার হাজার তাঁতি কাজ করতো। এখানকার প্রায় সব তাঁতিরা হ্যান্ডলুম মেশিনে কাজ করে। এই হ্যান্ডলুম মেশিনকে চিত্তরঞ্জনও বলা হয়।
পুরো গ্রাম এই চিত্তরঞ্জনের খুট-খাট শব্দে মুখরিত থাকত। সকলের ঘুম ভাঙ্গত এই খুটখাট আওয়াজে। কিন্তু বর্তমানে হাতে গনা ৫/৬ টি বাসায় সব মিলিয়ে মাত্র ২০/২৫ টি তাঁতযন্ত্র রয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে, যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চিত্তরঞ্জন যেনো আর টিকে থাকতে পারছে না অটো মেশিনের সাথে। তাই অনেকেই এই পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায় অন্য কাজে।
আসলে কেনো এতো তাড়াতাড়ি এই শিল্পের পতন ঘটেছে…? কেনো এই পেশা থেকে তাঁতিরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে…?
এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় –
• দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি,
• সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা,
• স্বল্প মজুরি,
• আধুনিক মেশিন।
• কাপড়ের সঠিক মূল্য না পাওয়া,
• চোরা পথে আসা ভারতীয় নিম্নমানের কাপড়,
• স্বল্প মজুরি – দিন দিন কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় তাঁতের কাপড়ের দাম পাচ্ছে না তাঁতীরা। আবার কর্মীদের বেশি মজুরি দিতে পারে না তাই কর্মীরা এই স্বল্প আয় দিয়ে অগ্নিমূল্যের বাজারে তাদের ঘরসংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। সেজন্য অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে।
• এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার আরো একটি কারন হিসেবে বলা যায় সঠিক দিকনির্দেশনা ও বাজারজাত করনের অভাব।
ই-কমার্সে তাঁতশিল্পঃ
ই-কমার্স একমাত্র সঠিক বাজারজাতকরন ও প্রচারের মাধ্যম হতে পারে দিনাজপুরের তাঁত শিল্পের।
কারন তাঁতিশিল্পের সঠিক বাজারজাতকরন ও প্রচারের অভাবে এই তাঁতে তৈরি কাপড় একসময় মসলিনের মতো ইতিহাস হয়ে যাবে।
বর্তমান যুগ ই-কমার্সের যুগ। তাই বাংলাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে যে ডিজিটাল সেন্টারগুলো আছে, তার মাধ্যমে ই-কমার্সকে সেখানে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। ই-কমার্স খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর ই-কমার্সের বাজার বড় হচ্ছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের এই প্রকোপের সময় অনলাইন ভিত্তিক পণ্যের বাজার রাতারাতি অনেক বেড়ে গেছে।
কিন্তু এখনো প্রধান শহরগুলোর বাইরে ই-কমার্সের সেবা পুরোপুরি পৌঁছায়নি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার মানুষজন এখনো ই-কমার্স সেবার বাইরে রয়েছে। দিনাজপুরের তাঁত পল্লীপন্য গুলোকে আমরা ই-কমার্সের মাধ্যমে বাজারজাতকরন করতে পারলে দিনাজপুরের মৃতপ্রায় তাঁতশিল্প আবার তার প্রাণ ফিরে পাবে। তাঁত পন্যের বাজার বৃদ্ধি পাবে সৃষ্টি হবে হারিয়া যাওয়া তাঁত শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
একমাত্র ই-কমার্সের মাধ্যমেই এই তাঁত পল্লীর হারিয়ে যাওয়া চিত্তরঞ্জনের খটখট ধ্বনি ও জীবনের গতি আবার ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।
রোকাইয়া চৌধুরী তন্বী
দিনাজপুর।