এক সময় বিশ্বের ধনী দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম। না, রূপকথার গল্প নয়। ব্রিটিশরা বাংলা দখল করার আগে বরাবরই অর্থনৈতিক ভাবে বেশ সমৃদ্ধ ছিল এ দেশ। আর এই সমৃদ্ধির পেছনে অন্যতম অবদান ছিল তাঁত শিল্পের। রপ্তানি আয়ে পিছিয়ে গেলেও তাঁত শিল্প এখনো গ্রামীণ পর্যায়ে কর্ম সংস্থানে ব্যপক ভূমিকা পালন করছে। গত ২ বছর ধরে অনলাইনে দেশি পণ্যের প্রচারে যে ঢেউ উঠেছে তার ফলে দেশীয় শাড়ির ব্যপারে আগ্রহ এবং বিক্রি দুইই বেড়েছে।
দেশে ই-কমার্সের প্রসারের কারনে দেশি শাড়ির বাজার অনেক বাড়তে পারে। এজন্য সময় এসেছে অনেকে মিলে এক সাথে কাজ করার। বাংলাদেশের শাড়ির কোয়ালিটি বা গুণ গত মান নিয়ে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। আসল সমস্যা হল প্রচারের অভাব। যেমন আমরা অনেকেই জানিই না যে বাংলাদেশে বিয়ের লেহেঙ্গা তৈরি হয়। ফলে বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের পরনে বিদেশি লেহেঙ্গা থাকবে এটিই যেন নিয়ম হয়ে গেছে।
২০ হাজার টাকা উপরে দামি শাড়ি গুলোর একটা বড় অংশই বিদেশি। অথচ জামদানি, বেনারসি ২০ হাজার টাকার উপরের বাজেটে শাড়ি গুলো সব দিকেই সেরা। শুধু না জানার ফলে দেশি শাড়ি পিছিয়ে আছে মার খাচ্ছে।
গত দু বছরে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দেশীয় তাঁতের শাড়ি। দেশে প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। আর বাঙালী নারী মানেই শাড়ির সাথে গভীর একাত্মতা রয়েছে। প্রতিদিনের পোশাকে বর্তমানে শাড়ি না থাকলেও বাঙালী নারীর উৎসব মানেই শাড়ি এবং উৎসব ভেদে চাই শাড়ির ভিন্নতা। কিন্তু খুব কম সংখ্যক দেশীয় শাড়ির সাথে আমরা পরিচিত বলে বিদেশী শাড়ির উপর নির্ভরতা বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতগুলোতে প্রায় ১০০ প্রকারের বা তার বেশি ভ্যারিয়েশনের শাড়ি তৈরী হয়ে থাকে, আর আমরা হাতে গোনা কয়েক প্রকার শাড়ির নাম এবং বিশেষত্ব নিয়ে জানি।
আর তাই বেশির ভাগ শাড়ি সম্পর্কে না জানার কারণে, সেগুলো প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে বলা যায়। আবার আমাদের অজ্ঞতার কারণে, পর্যাপ্ত তথ্য না জানার কারণে অনেক দেশীয় শাড়ি ভারতীয় শাড়ি বলে প্রচার এবং বিক্রি করা হচ্ছে। এতে দেশের অনেক অঞ্চলের হ্যান্ডলুম তাঁতশিল্পগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, তাঁতিরা পেশা ছেড়ে অন্যভাবে জীবনধারণ করছে। আর তাই দেশীয় শাড়ির চাহিদা তৈরীতে সবার আগে দরকার সঠিক উপায়ে এগুলোর প্রচার করা।
অনলাইনে দেশীয় শাড়ির প্রচারের জন্য সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হল ফেসবুক। কারণ দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী ফেসবুকের সাথে যুক্ত, বিটিআরসির হিসাব মতে বর্তমানে প্রায় ৫ কোটির মত ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে, যার একটা বড় অংশই হল নারী।
এ ছাড়াও ই-কমার্স ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশে এবং দেশের বাইরে সমান ভাবে দেশীয় শাড়িগুলোকে জনপ্রিয় করা যেতে পারে আকর্ষনীয় উপস্থাপনার মাধ্যমে। এভাবে অনলাইনে দেশীয় শাড়ি প্রচারের মাধ্যমে চাহিদা যদি আরও এক কোটিও বৃদ্ধি করা যায়, তাহলেও বহু সংখ্যক তাঁতিদের অবস্থা ফিরবে, বিভিন্ন ধরণের দেশীয় শাড়িকে ফোকাস করে অনেক অনলাইন উদ্যোক্তা তৈরী হবে, আর এতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।
১) সেল পোস্ট এভোয়েড করে কন্টেন্টের উপর গুরুত্ব দিতে হবেঃ
অনলাইনে দেশীয় শাড়ির প্রচারণায় প্রধান অন্তরায় হল, তথ্যবহুল কন্টেন্টের অভাব। অনলাইন উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই লাইভ করা এবং সেল পোস্ট দিতেই বেশি আগ্রহী, পণ্যের বিশেষত্ব আকর্ষনীয়রূপে তথ্যবহুল কন্টেন্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করার থেকে। এতে বার বার একই ধরনের সেল পোস্ট দেখে ক্রেতারা ক্লান্ত হয়ে যায়, আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
তাই দেশীয় শাড়ী প্রচারে ভালো মানের কন্টেন্টের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। আকর্ষনীয় কন্টেন্ট লেখার জন্য শাড়িগুলো সম্পর্কে প্রথমে পর্যাপ্ত জানতে হবে, যেমন- শাড়িটার নাম, এর ইতিহাস, বুনন কৌশল, বিশেষত্ব , গুনাগুন, ব্যবহার, যত্ন ইত্যাদি সম্পর্কে যত বেশি জানা যাবে তত বেশি তথ্যসমৃদ্ধ কন্টেন্ট লেখা সম্ভব হবে, ক্রেতাদের তত বেশি জানানো যাবে এবং আগ্রহী করা যাবে।
২) বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি কন্টেন্টে জোর দিতে হবেঃ
অনলাইন জগতে আমাদের দেশীয় শাড়িগুলো সম্পর্কে বাংলায়ই খুব বেশি তথ্য প্রায় নেই বললেই চলে, আর ইংরেজীতে তো একদমই নেই বলা যায়। অথচ আমাদের দেশীয় তাঁতের শাড়িগুলো অনেক বেশি আকর্ষনীয়, একটু সুদৃষ্টি দিলে ভালোভাবে প্রচার করলে যেগুলোর চাহিদা তৈরী করা যায় সারাবিশ্বেই। ফেসবুক এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে আমাদের দেশীয় শাড়িগুলোর বৈচিত্র্যতা ও বিশেষত্ব সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি আলাদা ধরণের শাড়ি নিয়ে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায়ও পর্যাপ্ত কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে।
প্রত্যেকটা শাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশেষত্ব সম্পর্কে যখন মানুষ এভাবে জানতে পারবে তখন বিশ্ববাজারে আমাদের দেশীয় শাড়ির ব্যাপক চাহিদা তৈরী করা সম্ভব হবে।
৩) কম জনপ্রিয় শাড়িগুলোকে জনপ্রিয় করতে হবেঃ
মসলিন, জামদানী, বেনারসি, কাতান ইত্যাদি এই কয়েক প্রকারের দেশীয় শাড়ির নামই আমাদের মাথায় ঘুরে ফিরে আসে, অথচ শত রকমের দেশীয় শাড়ি আমাদের তাঁতিরা বুনে থাকে। কম পরিচিত বা একদমই নাম না জানা শাড়িগুলোকে পরিচিত করতে তাই অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে নিয়মিত কন্টেন্ট লিখতে হবে প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের শাড়ি নিয়ে।
কম পরিচিত একটা বিশেষ শাড়ি হিসেবে টাঙ্গাইলের তাঁতে বোনা মাসলাইস শাড়ির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মাসলাইস নামটাই এখনো প্রায় ৯০% নারীর কাছে অজানা। অথচ এটি বেশ উচ্চমানের কটন শাড়ি, যা সিল্কের মত গ্লেসি এবং এই শাড়িগুলোর মাঝেই শত রকমের ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইন রয়েছে। আর এর নাম না জানার কারণেই, গত বছর হঠাৎ এই শাড়ির ট্রেন্ড তৈরী হওয়ায় অনলাইনে অনেক অসাধু বিক্রেতারা এই শাড়িকে ভারতীয় শাড়ি বলে প্রচার এবং বিক্রি করেছে।
এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে তাই নিয়মিত শাড়িগুলো নিয়ে লেখালেখি করা, ছবি, অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্টের মাধ্যমে আকর্ষনীয় রূপে উপস্থাপন করার কোনো বিকল্প নেই।
শেষ কথাঃ অনলাইনে প্রচারনায় যদি আমরা সফল হই তাহলে দেশি শাড়ির প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক বাড়বে। ফেইসবুকে পোস্ট দিতে কোন টাকা লাগে না। যা লাগে তাহল মানুষের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। অন্যরা কে কি করছে তা নিয়ে চিন্তা না করে আমরা যদি প্রতিদিন ফেইসবুকে দেশি শাড়ি নিয়ে পোস্ট দেই বা কমেন্ট করি তাহলে প্রতিদিন এমনিতেই দেশি শাড়ির প্রচার ১০-২০ লাখ লোকের কাছে হয়ে যাবে। এটি সহজেই করা সম্ভব যদি আমরা অনেকে এক হয়ে চেষ্টা করি।
রাজিব আহমেদঃ সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ই-ক্যাব।
খাতুনে জান্নাত আশাঃ দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তা (পিয়াসি)