ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য্যের কারণে চট্টগ্রাম শহর প্রাচ্যের রাণী হিসেবে পরিচিত বহুকাল আগে থেকেই। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত এই শহরটির প্রায় প্রতিটি স্থানের পিছনেই রয়েছে একেকটি ইতিহাস। আর এসবের সমন্বয়ের নগরীর ঠিক মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে চেরাগী পাহাড়। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে চেরাগী পাহাড়ের প্রাচীন ইতিহাসও জড়িত।
কথিত আছে , সুদূর অতীতে আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে বদর শাহ নামক একজন সুফি সাধক ভাসমান একখণ্ড পাথরের উপর আরোহণ করে পূর্ব দেশে রওনা হন। তারপর একদিন পাথরখণ্ডটি বদর শাহকে নিয়ে কর্ণফুলি নদীতে প্রবেশ করে এবং নদীর যে স্থানে পাথরটি থেমে যায় সেইস্থানে তিনি নেমে যান। পরবর্তীকালে বদর শাহকে বহনকারী পাথরের স্মারকরূপে সে স্থানটি ‘পাথরঘাটা’ নামে খ্যাত হয়।
তখন সমগ্র চট্টগ্রাম শহর ছিল জনমানবহীন গভীর অরণ্যে আবৃত। সেখানে ছিল জ্বীন-পরীর আবাসস্থল। বদর শাহ একটি মাটির চেরাগ হাতে নিয়ে পাথরখণ্ড থেকে নেমে তীরে উঠে গভীর বন-জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি পাহাড়ের উপর উঠলে জ্বীন-পরী তাঁকে বাধা দেয়।
তারা তাদের মুল্লুকে কাউকে অনধিকার প্রবেশ করতে দিবে না বলে জানালে, বদর শাহ বলেন “আমি একজন সংসারবিরাগী বৃদ্ধ। আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করার মানসে এখানে এসেছি। আমাকে এখানে থাকার স্থান দাও। কিন্তু জ্বীন-পরীরা কোনমতে তাঁকে স্থান দিতে রাজি না হলে, বদর শাহ রাতের অন্ধকারে শুধুমাত্র চেরাগটি রেখে জ্বালাবার স্থানটুকু দিতে বলেন। এতে জ্বীন-পরীরা রাজি হয়। এরপর তিনি হাতের চেরাগ পাহাড়ের উপর রাখলেন এবং নিজের আলখাল্লার পকেট থেকে দুটি চকচকে পাথর বের করে একটির সাথে আর একটি ঘষে আগুন বের করে চেরাগ জ্বেলে দিলেন।
দেখতে দেখতে চেরাগের রোশনাই (আলো) উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকলো। কিন্তু সে রোশনাই থেকে এমন এক তীব্র তেজ বিকিরণ করতে থাকলো যে চট্টগ্রামে বসবাসকারী সমস্ত জ্বীন-পরীরা শরীরে এক তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। এবং একসময় বদর শাহ এর অলৌকিক চেরাগের আলোর তেজ সহ্য করতে না পেরে জ্বীন-পরী চিরতরে চট্টগ্রাম পরিত্যাগ করে চলে যায়। এরপর চট্টগ্রাম আবাদ হয়। বদর শাহর চেরাগ রাখার স্থানটি ‘চেরাগী পাহাড়’ নামে খ্যাত হয়। আজও চেরাগী পাহড়ের স্মারকস্বরুপ একটি স্থাপনায় হিন্দু- মুসলিম অধিবাসীরা মানত করে মোমবাতি জ্বালায়।
কিন্তু বর্তমানে গল্পের সেই চেরাগী পাহাড়ের অস্তিত্ব খুঁজতে গেলে শুধু হতাশই হতে হবে। কেননা ওখানে এখন কোনো পাহাড় নেই, শুধু রয়েছে মন্দিররুপী একটি স্থাপনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি বিশাল চত্বর এবং সারি সারি দালান। তবে হ্যাঁ, চট্টগ্রাম শহরের বেশ কিছু এলাকার মত ঔ এলাকাটিও অন্যান্য এলাকার তুলনায় কিছুটা উঁচু। বর্তামানে এটি চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সৃজনশীল চর্চার চারণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এলাকাটি ‘চেরাগী পাহাড় চত্বর’ বা ‘চেরাগী মোড়’ নামেই পরিচিত। সময়ের সাথে নানা বয়সের জ্ঞানমনষ্ক মানুষের আনাগোনায় নিত্য সরগরম হয়ে ওঠে এই চেরাগী পাহাড় চত্বর। এখানে কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যজন, শিল্পী, গায়ক, সৃজনশীল বইপত্রের পাঠক, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিককর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আনাগোনা ও আড্ডায় মুখরিত হয়ে থাকে পুরো এলাকার পরিবেশটি।
চেরাগী পাহাড়ের অবস্থান ডিসি হিলের উত্তর পাশে মোমিন রোড এবং জামাল খান রোডের সংযোগ স্থলে। তাই চতুর্দিকের পেশাজীবী, চাকরীজীবী, শিক্ষক-ছাত্র হতে শুরু করে মননশীল মানুষের মিলনের মোহনায় পরিপূর্ণ থাকে জায়গাটি। এছাড়াও বিভিন্ন মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রধান অফিস ও ব্যুরো কার্যালয় থাকায় অনেকের কাছে এই স্থানটি বিশেষভাবে আকৃষ্টের উপকরণ।
সন্ধ্যা হলেই আড্ডা জমায় ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণীর পাশাপাশি সব বয়সী মানুষ, আড্ডার ফাঁকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চটপটি, ফুচকা আর চা-পান তো রয়েছেই। মধ্য রাতেও মুখর চেরাগী মোড়। রাত ২টা ৩টার আড্ডারুরা ভিন্ন ক্যাটাগরির হয়। পত্রিকা ও প্রেসের কর্মীরা সামান্য স্বস্তিতে বিশ্রাম করতে চেরাগী মোড়ে আড্ডা জমায় নির্জন রাতে। সব দোকানপাট খোলা না থাকলেও যে দুয়েকটা খোলা থাকে সেদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে চা-বিস্কিট আর একটা সিগারেটের জন্য।
মিডিয়াপাড়া হিসেবে খ্যাত চেরাগীর মোড়ে রয়েছে হরেক রকম হাট। অসংখ্য দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, প্রকাশনা সংস্থা, মুদ্রণ, হকার সমিতি, সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান, ব্যান্ড দল, ব্যাংক-বীমা, অ্যাডফার্ম, স্টেশনারি প্রতিষ্ঠান সহ মোড়ের একপাশে রয়েছে বিশাল এক ফুলের রাজ্য। অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এই ফুলের দোকানগুলো এলাকাটিতে অন্যতম নান্দনিক পরিবেশের রূপ দিয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা। দেখলে মনে হবে এ যেন পুরোটায় ফুলের রাজ্য। আর ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করে পুরো এলাকাটি। এ যেন প্রাণের তৃষ্ণা মেটানোর এক অপূর্ব মিলনমেলা।
–জুলিয়া আফরোজ
সত্ত্বাধিকারী – “বর্ণিল রঙ্গন” ও “চারুবৃত্ত”