ইট পাথরের দেয়ালে ঘেরা ব্যস্ততাময় শহরে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার জায়গা খুঁজতে হলে যেতে হবে কোনো পার্ক বা খোলা মাঠে। আধুনিকায়নের ফলে আজকাল খোলা মাঠ বলতে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বরং নানান কৃত্রিম উপকরণ আর সাজসজ্জায় কিছুটা প্রাকৃতিক পরিবেশের আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে শহরের বিভিন্ন পার্কে। অবশ্য এছাড়া আর উপায় কি! প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া তো মানুষ প্রাণ খুলে বাঁচতে পারে না। আর ওই প্রকৃতির স্বাধ গ্রহণ করার জন্যই শহুরে মানুষগুলো এখন ভিড় জমায় বিভিন্ন পার্কে।
ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার হলেও, এই শহরে রয়েছে নানান কৃত্রিম পার্ক। ক্যাফে ২৪ পার্ক (Cafe 24 Park)ও এমনই একটি পার্ক। প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উভয় পদ্ধতির সংমিশ্রণে তৈরি এই পার্কটি চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে অবস্থিত। এটি সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি পার্ক। ভাটিয়ারী থেকে হাটহাজারী সংযোগ সড়কে ৭ কিমি পর এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট এর একটু আগেই ক্যাফে ২৪ পার্কটি অবস্থিত৷
গতানুগতিক শিশুপার্ক বা এমিউজমেন্ট পার্কগুলোতে যেসব রাইড থাকে ক্যাফে ২৪ পার্ক তাঁর পুরোটাই ব্যতিক্রম। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক, বিভিন্ন প্রকার রাইড, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুড আইটেম পরিবেশনায় একটি রেস্টুরেন্ট। সেনাবাহিনীর অধীনে পরিচালিত হওয়াতে এই পার্কের ভিতর ও বাহির সবখানে সাজানো গোছানো ও খুবই পরিষ্কার। প্রশিক্ষনের সময় সেনাবাহিনী যেসব উপকরণ ব্যবহার করে থাকেন এখানে সেসবের গুটিকয়েক সাধারণ জনগণের জন্য বানানো হয়েছে। নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে দর্শনার্থীরা এগুলো ব্যবহার করে পুরোপুরি ধারণা নিতে পারবে।
ক্যাফে ২৪ পার্কটি খুবই অসাধারণ একটি বেড়ানোর জায়গা এবং এই পার্ক এর যে কোন রাইডে যতবার খুশি উঠা যাবে। এখানের কিছু কিছু রাইডে নিরাপত্তার কারনে একত্রে একজনের বেশি ওঠা নিষেধ। প্রতিটি রাইডে চড়তে গিয়ে আপনি অনুভব করবেন অদ্ভুত রকমের থ্রিলিং। সেই সাথে রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ তো আছেই।
এ পার্কটির কৃত্রিম অংশগুলো কিছুদিন পর পর পরিবর্তন করে নতুনত্ব আনা হয়। পার্কটি চালু হওয়ার শুরুর দিকে পার্কে প্রবেশের পর হাতের ডানপাশে ছিলো গ্রাম্য পরিবেশের মতো করে কিছু ঘর এবং বাঙালি সংস্কৃতির একটি চিত্র। যেগুলোর মধ্যে বাঙালী ঘর এর পাশাপাশি রয়েছে চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা ধরনের ঘর। বর্তমানে এই স্থানটিতে তৈরি করা হয়েছে একটি ইটের তৈরি মঞ্চ, যেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। মঞ্চের পাশেই রয়েছে একটি বিরাট পাখির খাঁচা, যেখানে রয়েছে বাজরিগার, লাভবার্ড, কবুতর সহ হরেক রকমের পাখি। মঞ্চ পেরিয়ে সামনে আগালেই রয়েছে একটি এডভেঞ্চার ট্রেইল (Adventure Trail) এর পাহাড় এবং পাহাড়ের পাশের রাস্তা ধরে আগালে ভিতরের দিকে রয়েছে একটি নার্সারি৷ পার্কের বাম পাশে রয়েছে ছাউনিযুক্ত একটি হলঘর, যেটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। পার্কের এই পাশটিতে আরো রয়েছে সুবিশাল একটি লেক যেখানে আছে মাছ ধরার ব্যবস্থা এবং বোট ভ্রমনের সুবিধা।
এডভেঞ্চার ট্রেইলের শুরুতেই রয়েছে একটি নেট ওয়ে। এই পথটি ওঠার জন্য ভালো, তুলনামূলক সমতল এবং অল্প ঢাল বিশিষ্ট। উপরের ঝুলন্ত রশি ধরে নিচের রশি বরাবর পা রেখে হেঁটে যেতে হয়। জালে পা পড়লেই নিচের দিকে গেড়ে যাবেন। তখন হাঁটতে কষ্ট হবে। এরপরে পাবেন স্পাইডার নেট। এটি অনেকটাই মাকড়সার জালের মতোই। রশিতে পা রেখে এবং সুবিধামতো উচ্চতার রশি ধরে দেখে দেখে হেঁটে সামনের দিকে যেতে হয়। এখানে আছে মাটি থেকে প্রায় ১০ ফুট উঁচুতে কাঠ নির্মিত একটি গোলক ট্রেইল। গোলকের ভেতর দিয়ে ক্রল করে করে এগিয়ে যেতে হবে। এই গোলকের দৈর্ঘ্য হবে ২৫-৩০ ফুট। আরও আছে এয়ার ওয়াকার। ঝুলন্ত টায়ারের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। এটার ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকতে হবে কারন এক টায়ারে পা রাখলে আর এক টায়ার অনেকটাই সরে যায়। তখন সেটায় আরেক পা দেয়া অনেক ব্যালেন্সের একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরকম আরও বেশ কয়েকটি ট্রেইলের স্বাদ নিতে পারবেন এডভেঞ্চার ট্রেইলে। এই এডভেঞ্চার ট্রেইলের জন্য রয়েছে আলাদা টিকেটের ব্যবস্থা।
এছাড়া পার্কের বাম পাশে যে লেকটি রয়েছে, সেটিই পার্কটির মূল আকর্ষণ। লেক এর এক ধারে রয়েছে বেশ কিছু গাছ এবং গাছোর ছায়ায় বসার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ। লেকের অন্য ধারে রয়েছে পাহাড়ের বুক বেয়ে আঁচড়ে পরা কৃত্রিম একটি ঝর্ণা। লেকটির চারধারের শীতল সবুজ প্রকৃতি আপনার মনকে দিবে পরম প্রশান্তি। তাইতো ছুটির দিনগুলোতে এই পার্কে শহুরে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে দলে দলে মানুষ ভিড় জমায় একটুকরো প্রশান্তির ছোয়া পেতে।
ক্যাফে ২৪ ভ্রমণের জন্য শুরুতে চট্টগ্রাম শহরে আসতে হয়। এরপর শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস কিংবা সিএনজি যোগে হাটহাজারির সামান্য আগে “বড় দিঘির পাড়” নামক স্থানে নামতে হয়। সেখান থেকে ভাটিয়ারির লেগুনা বা সিএনজি’তে চড়ে একটু সামনে গেলেই ক্যাফে ২৪ পার্ক। ক্যাফে ২৪ পার্ক সংলগ্ন একটি কাঁচা বাজার রয়েছে, সেটি ৩ নং বাজার নামে পরিচিত।
এছাড়া ঢাকা থেকে বাসযোগে এসে কেউ যদি ক্যাফে ২৪ পার্ক ভ্রমণ করতে চান, তাহলে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী নেমে গিয়ে সেখান থেকে লেগুনা বা সিএনজি করে ভাটিয়ারী ৩ নং বাজার / ক্যাফে ২৪ পার্কের সামনে নেমে গেলেই সহজেই পার্কটি ভ্রমণ করা যাবে।
–জুলিয়া আফরোজ
স্বত্তাধিকারী – “বর্ণিল রঙ্গন” ও “চারুবৃত্ত”