দূর থেকে দেখলে মনে হয় ফণী মনসা। কাছে গেলে ভুল ভাঙে। কাঁটা জাতীয় গাছে ঝুলে লাল ফল। ড্রাগন- এই ফল চাষেই মেতে এখন আমাদের দিনাজপুরের অনেক কৃষক। অনেকে যদিও শখের বসে শুরু করেছিলেন। এখন অবশ্য সবাই এটাকে পেশা হিসেবেই নিয়েছেন। দিনাজপুরের অনেকের বাড়িতেই একটা দুইটা করে ড্রাগনের গাছ পাওয়া যাবে। অনেকেরে ছাঁদ বাগানেও শোভা পায় এই ড্রাগন।
ড্রাগন ফলের রূপও অতি সহজেই নজর কাড়ে। ফলের ভেতরটা যেমন রাঙা, খেতেও সুস্বাদু। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ফল পুষ্টিগুণে ভরপুর। বেলে ও দোআঁশ মাটি ড্রাগন চাষের পক্ষে আদর্শ। চারা রোপণের জন্য উপযোগী সময় হলো এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। রোপণের পর এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। এটি একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক চাষ। মূলত আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ায় ড্রাগন ফলের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। বর্তমানে ভারতেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ড্রাগন ফলের চাষ। গতানুগতিক কৃষির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সময়ের প্রয়োজনে লাভজনক ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চাষিরা। যার ফলাফল বাংলার বিভিন্ন জেলার আনাচে-কানাচে বাড়ছে ড্রাগন ফলের চাষ।
দিনাজপুরের কান্তনগরে কান্তজির মন্দিরের পাশে দেখা যায় অনেক বড় একটা বাগান, কিংবা দিনাজপুর থেকে দশমাইল রোডে সেতাবগঞ্জ সুগারমিলের কান্তা খামারেও দেখা পাওয়া যায় প্রায় ১৫ একর জমিতে বিশাল ড্রাগন বাগান। দিনাজপুর থেকে বাইরে সেতাবগঞ্জ,বিরামপুর, কাহারোল, নবাবগঞ্জ, ফুলবাড়ি, সহ আরো অনেক উপজেলাতে ড্রাগনের চাষ বাণিজ্যিকভাবেই করা হয়।
ড্রাগন ফল সাধারণত তিন প্রজাতির হয়ে থাকে-
১) লাল ড্রাগন ফল বা পিটাইয়া। এর খোসার রঙ লাল ও শাঁস সাদা। এই প্রজাতির ফলই বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
২) কোস্টারিকা ড্রাগন ফল। খোসা ও শাঁস উভয়ের রঙই লাল।
৩) হলুদ রঙের ড্রাগন ফল। এই জাতের ড্রাগন ফলের খোসা হলুদ রঙের ও শাঁসের রঙ সাদা।
ড্রাগন ফল (যা পিতায়য়া নামেও পরিচিত) এটি এক প্রজাতির ফল, একধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির ফল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এর মহাজাতি হায়লোসিরিয়াস (মিষ্টি পিতায়য়া)। এই ফল মূলত ড্রাগন ফল হিসেবে পরিচিত। গণচীন-এর লোকেরা এটিকে আগুনে ড্রাগন ফল এবং ড্রাগন মুক্তার ফল বলে, ভিয়েতনামে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফল, থাইল্যান্ডে ড্রাগন স্ফটিক নামে পরিচিত। অন্যান্য স্বদেশীয় নাম হলো স্ট্রবেরি নাশপাতি বা নানেট্টিকাফল। এই ফলটি একাধিক রঙের হয়ে থাকে। তবে লাল রঙের ড্রাগন ফল বেশি দেখা যায়।
পুষ্টিবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে ড্রাগন ফলের উপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, এতে ক্যালোরির পরিমাণ কম থাকে বলে ‘ডায়েট’ করার সময় এটি খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ড্রাগন ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ঠিক রাখার জন্য সাধারণত এটি কাঁচা অবস্থাতেই খাওয়া হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলের সাদা বা লাল অংশে ২১ মি.গ্রা. ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা দৈনিক ভিটামিন সি’র চাহিদার ৩৪ শতাংশ পূরণ করতে সাহায্য করে। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে যে পরিমাণ ভিটামিন সি পাওয়া যায় তা একটি কমলার সমান বা তিনটি গাজরের চেয়ে বেশি ভিটামিন সি সরবারহ করতে সক্ষম। ভিটামিন সি’র মাত্রা বেশি থাকায় এই ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, মানসিক অবসাদ দূর করে এবং ত্বক সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।
প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ৩ গ্রাম আঁশ থাকে যা দৈনিক চাহিদার ১২ শতাংশ। ড্রাগন ফলের আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিকারক হিসেবে কাজ করে। এই ফলের কালো বীজে থাকে ল্যাক্সেটিভ ও পলিআনস্যাচুরেইটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা হজমে সাহায্য করে ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধের সহায়ক। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে জলীয় শতাংশ থাকে ৮৭ গ্রাম, প্রোটিন ১.১ গ্রাম, ফ্যাট ০.৪ গ্রাম (বলতে গেলে ফ্যাট নাই) এবং কার্বোহাইড্রেট ১১.০ গ্রাম। এছাড়াও এতে বেশ কিছু ভিটামিন ও খনিজ উপদান থাকে যা মানবদেহের সুস্থতার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ০.০৪ মি.গ্রা. ভিটামিন বি ১, ০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন বি ২, ০.০১৬ মি.গ্রা ভিটামিন বি ৩ এবং ২০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ড্রাগন ফল আয়রনের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ১.৯ মি.গ্রা. আয়রন থাকে। এছাড়াও এতে ক্যালসিয়াম থাকে ৮.৫ মি.গ্রা. এবং ফসফরাস থাকে ২২.৫ মি.গ্রা.।
জানেন ড্রাগন ফল আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা দূর করতে পারে। ত্বকের উজ্জ্বল্য রক্ষা থেকে শুরু করে ওজন কমানোতে সিদ্ধহস্ত ইনি। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। যা আপনাকে ব্রণর সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে। ব্রণযুক্ত অঞ্চলগুলিতে ফলের রস লাগিয়ে স্ক্রাব করলেও উপকার মেলে। রোদে ঘুরে ত্বকে ট্যান পরে গেলে, ভিটামিন ই এর ক্যাপসুলের সঙ্গে ১/৪ ড্রাগন ফলের মিশ্রণ ত্বকে লাগালে চটজলদি রেজাল্ট পাবেন। এছাড়াও, আপনি যদি কোনও প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার খুঁজে থাকেন তবে ড্রাগনের ফলের উপর নির্ভর করুন কারণ এর ৮০ শতাংশ কেবল পানি।
ড্রাগন চাষ কিছুটা ব্যয়বহুল। গাছের গোড়ার আগাছা অপসারণ করে নিয়মিত সেচ প্রদান এবং প্রয়োজনে চারপাশে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ লতানো এবং ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হওয়ায় সাপোর্টের জন্য ৪ টি চারার মাঝে ১টি সিমেন্টের ৪ মিটার লম্বা খুঁটি পুততে হবে। চারা বড় হলে খড়ের বা নারিকেলের রশি দিয়ে বেধে দিতে হবে যাতে কাণ্ড বের হলে খুতিকে আঁকড়ে ধরে গাছ সহজেই বাড়তে পারে। প্রতিটি খুঁটির মাথাই একটি করে মটর সাইকেলের পুরাতন টায়ার মোটা তারের সাহায্যে আটকিয়ে দিতে হবে। তারপর গাছের মাথা ও অন্যন্য ডগা টায়ারের ভিতর দিতে বাইরের দিকে ঝুলিয়ে দিতে হবে। কেননা এভাবে ঝুলন্ত ডগাই ফল বেশি ধরে ।
দিনাজপুর জেলায় ড্রাগন চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরীক্ষামূলক চাষের পর এবার অনেকেই বাণিজ্যিক ভাবে এর চাষ শুরু করেছেন। এর ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে এবং কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে এমন দামী একটা ফলের চাষ করে।
লেখক : তানিয়া ইসলাম মধুবন্তী।